মার্কেটিং চাকরি

মার্কেটিং চাকরি আসলে কাদের জন্য!

মার্কেটিং চাকরি সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই জানি। এই চাকরি বাইরে থেকে খুব ফিটফাট হলেও ভেতরের দিকটা সদর ঘাটের মতো। তবে সফলতা সব জায়গায় থাকে, কম আর বেশি। মার্কেটিং চাকরি করতে যারা আসে আপনি যদি জরিপ করেন তাহলে দেখবেন যে, বেশিরভাগই বিভিন্ন জায়গায় ব্যর্থ হয়ে শেষ অপশন হিসেবে আসে। তাহলে যারা শেষ অপশন হিসেবে এখানে আসে মার্কেটিং চাকরিটা মূলত তাদেরই জন্য।

কিন্তু আসলে তা নয়। মার্কেটিং চাকরি তাদের জন্যই নয়। এই চাকরি করতে হলে আপনার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। আপনাকে অনেক বেশি কথা বলা জানতে হবে, মিথ্যা বলার অভ্যাস থাকতে হবে, কেউ অপমান করলেও হাসিমুখে ফিরে আসতে হবে, এক দোকানের প্রোডাক্ট আরেক দোকানে বিক্রি করতে হবে, ব্রোকারের কাছে প্রোডাক্ট বিক্রি করতে হবে আর কত কি!

বলা যায়, একটি যান্ত্রিক জীবন আপনাকে মেনে নিতে হবে। এই যান্ত্রিক জীবনে আপনি কাউকে-ই খুব বেশি সময় দিতে পারবেন না। পরিবারকেও সময় দিতে পারবেন না। পরিবারেও দোষী থাকবেন আবার সেলস সামান্য খারাপ হলে বসদের কাছেও দোষী।

এখানে আসার জন্য আপনাকে খুব বেশি পড়াশোনা করতে হবে না। কোনরকমে টেনে টুনে পাশ করলেও চলবে। আমি বলছি না যে, লেখাপড়ায় যারা ভালো তারা আসে না, তারাও আসে তবে পরিমাণটা সংখ্যায় খুব কম। আর অন্য সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা এক মুহূর্তও এখানে অবস্থান করে না।

আসলে এই চাকরিই আপনি যদি বিদেশে গিয়ে করেন তবে দেখবেন অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন, পরিবেশটা আলাদা। আমাদের দেশের মতো এতো হিজিবিজি অবস্থা নয়। আজকে আমি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলোর কথা বলবো।

বাংলাদেশে যতো চাকরি আছে তন্মধ্যে এটাই সবচেয়ে সহজলভ্য। এই চাকরির সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এখানে আপনাকে সত্যিই কোন ঘুষ দিতে হবে না। কিন্তু চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে যতোদিন চাকরি করবেন ততদিনই সবাইকে তেল মেরে চলতে হবে। তেল মারতে না পারলেই বস বলবে আপনার পারফরমেন্স খারাপ।

বসদের কাছে আপনার ভালো হতেও সময় লাগবে না আবার খারাপ হতেও সময় লাগবে না। কোন একটা কাজে সামান্য ভুল করবেন বা সামান্য খারাপ হবে তাতেই আপনাকে বলবে আপনার ম্যাচিউর্ড হয়নি। এতো বছর থেকে কি শিখলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি মনে করি, এই চাকরি কারও জন্যই না। কিন্তু সবাই বাধ্য হয়েই আসে। ছোট্ট একটি দেশে এতো জনসংখ্যা – কিভাবে সবাই ভালো চাকরি পাবে? কোন সিস্টেমের নাই ঠিক, সব জায়গায় কেবল দুই নাম্বারি। একটা পুলিশের সর্বনিম্ন পদে (হাবিলদার) চাকরি নিতে গেলে লাগে ২০ লাখ টাকা। তাহলে যাদের টাকা পয়সা কিংবা মামা খালু নাই তারা যাবে কোথায়!

নিজ দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে শুনলাম – শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, তার বাসার সাবেক পিয়ন নাকি চারশো কোটি টাকার মালিক। আপনারাই বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব! আর এটাই বা কিভাবে সম্ভব যে, একজন দেশনেত্রীর বাসায় থেকে এতো টাকা মেরে দেয়া যায়! সবই আসলে ভাবার বিষয়। তাহলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কি অবস্থা।

আমার কেন জানি মনে হয়, বিদেশীদের চেয়ে বাঙালিরা বেশি পরিমাণে দোজখে যাবে। কারন, এরা তো সবসময় হারাম খাচ্ছে। পুলিশের প্রাক্তন আইজিপি বেনজীর তার চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ ১ কোটি সামথিং টাকা আয় করেছেন। ধরে নিলাম দুই কোটি টাকা। আর সে তো পুরো বাংলাদেশটাই কিনে নেয়ার মতো অবস্থা তৈরী করা শুরু করেছিল।

আর ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলোর অবস্থাও ঠিক তাই। কে কার চেয়ে বেশি সেলস করতে পারে এই অসম প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু প্রতিযোগী কারা – এটা কেউ ভাবছে না। এই অসম প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে গিয়ে অনেক এমপিও বা এমআইও নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছেন। কেউ বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসে কোম্পানীতে শোধ করছেন।

আর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনাকে দিয়ে পারলে ২৪ ঘন্টাই কাজ করাবে। ধরুন, সকাল সাড়ে আটটা কিংবা নয়টায় আপনার রিপোর্টিং। তাহলে আপনাকে নিশ্চয়ই ঘুম থেকে সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠতে হবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে চলে গেলেন মার্কেটে। সেই দেড়টা কিংবা দুইটা পর্যন্ত থাকলেন। তারপর বাসায় খাওয়া দাওয়া, গোসল ও একটু রেস্ট নিতে নিতে আপনার সময় শেষ। বেজে গেছে ৪টা, এবার আবার মার্কেটে যেতে হবে।

আসবেন কয়টায় তার কোন নির্ধারিত সময় নেই। কিন্তু আপনাকে ঠিকই চারটার সময় বের হতে হবে। কিছু কোম্পানী আবার দুপুরে বাসায় আসতেই দেয় না। আবার কিছু কোম্পানী বিকাল ৫টায় বের হতে বলে। তো যেটা বলছিলাম, ওই যে বিকেলে বের হলেন – আপনি ফিরবেন হয়তো রাত ১১ টা, ১২ টা কিংবা ১ টায়। তখন এসে সামান্য খেয়ে আবার ঘুম। আপনার স্ত্রী সন্তানদের সাথে কোন কথাই বলার সুযোগ হলো না। এভাবেই মাসের পর মাস বছরের পর বছর সময়গুলো শেষ হয়ে যাবে।

আবার মার্কেটে বিক্রি হয় ৩ লাখ টাকা, আপনাকে টার্গেট দিয়ে রাখবে অন্তত ৪ লাখ কিংবা তার বেশি। তাহলে এই অতিরিক্ত ১ লাখ টাকা কোথ্যেকে আসবে? এটার কোন সদুত্তর ম্যানেজমেন্ট আপনাকে দিতে পারবে না এবং কোনদিন দিবেও না। আপনি কিছু বলতে গেলেই আপনাকে চাকরির ভয় দেখাবে। মার্কেটিং-এ (ফার্মায়) যারা চাকরি করে তাদের বেশিরভাগেরই প্রতিদিন সকালে চাকরি চলে যায় আবার বিকেলে চাকরি থেকে যায়। এই হলো অবস্থা।

আমি বুঝি না, ডাক্তারদের কোম্পানীগুলো এতো কিছু কেন দেয়? ডাক্তার’রা তো রোগীর সেবা করার জন্যই এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন। তাদের তো ওষুধ লিখতেই হবে। কোন এমপিও যদি তাদের কাছে না যায় তবুও তাদের ওষুধ লিখতে হবে, প্রয়োজনে রিসার্চ করতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে। এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে ডাক্তারদের নিজেকে অভিজ্ঞ করে তুলতেই হবে।

কিন্তু কোম্পানীগুলো তাদের অসম প্রতিযোগিতার কারনে এমন অবস্থার তৈরী করেছে। যে কোম্পানী যতো বেশি টাকা দিতে পারবে সেই কোম্পানীর ততো বেশি ওষুধ ডাক্তার’রা লিখবে। কোন ডাক্তারকে কোম্পানীগুলো মূলত তাদের ওষুধ লিখতে বাধ্য করে। কোয়ালিটি দেখার আর সুযোগ থাকে না ডাক্তারের কাছে।

আর এমপিও’রা রোগী ঢুকলেই রোগীর সাথে ডাক্তারকে সালাম দিচ্ছে, প্রয়োজনে দরজা খুলে সালাম দিচ্ছে। ডাক্তারও বুঝে যাচ্ছে যে, তার প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন। তখন প্রয়োজন না হলেও হয়তো অনেক ডাক্তার’ই দুই একটা প্রোডাক্ট অতিরিক্ত লিখে দেয়। এই সবকিছুর জন্যে মূলত কোম্পানীগুলোই দায়ী।

একটা বিষয় লক্ষ্য করুন, এই অসম প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তারা ডাক্তারের পেছনে তারা যতো টাকা খরচ করছেন এই টাকার সেলস কম হলে তো আর কোম্পানীর ক্ষতি হতো না। এমপিও’রা যেভাবে ওষুধ বিক্রি করে কোন কোন ধান, পাট, গম ও ভুট্টা ব্যবসায়ীরাও এভাবে বিক্রি করে না। আমরা দিনের দিন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হয়ে যাচ্ছি।

আবার, ডাক্তারের চেম্বার কোন রোগী বের হলেই ৬/৭ জন এমপিও তাকে ঘিরে ধরছে। কেন, ছবি লাগবে। আরে ভাই – একজন তুলে সবাইকে দিলেই তো হয়ে যাচ্ছে। তাহলে রোগীও বিরক্ত হলো না আবার পরিবেশটাও সুন্দর থাকলো। কিন্তু এগুলোর হিতাহিত জ্ঞান একটু সত্যিই কম – তাই যতোই বুঝাবেন কিন্তু তারা বুঝবে না। আসলে প্রকৃত অর্থে দোষগুলো কোম্পানীর। কারন, তারা প্রেসক্রিপশনের জন্য এতো পরিমাণ চাপ দিয়ে থাকে যে, প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলাকেও তারা সেলস মনে করে।

একটু বিবরণ দিলাম। কারন, না দিলে বুঝতেন না। এখন আপনারাই বলেন, এই চাকরি করতে কারা আসে? যারা এ চাকরি সম্পর্কে কিছুই জানে না, যার সরকারি চাকরির বয়স শেষ, যার অন্য কোন চাকরি হলো না, যার পরিবার খুব গরীব, অসহায় ছেলেরা, অভিজ্ঞতা নিতে যারা আসে – মূলত এই প্রকৃতির লোকেরাই এই চাকরিতে আসে। কোন ভালো ফ্যামিলির কোন ছেলে খুব বেশিদিন এখানে অবস্থান করবে না যদি তার অন্য কোন ব্যবস্থা থাকে।

আরও অনেক কথা আছে। মার্কেটে যারা আসে, কাজ করে কেবল তারাই জানে। গাধার মতো এখানে খাটতে হয়। মাস শেষে ভালো একটা সেলারী পাওয়া গেলেও এটা মাসের অর্ধেক না যেতেই শেষ হয়ে যায়। কারন, অনেক খরচ আছে, লস আছে ইত্যাদি।

পরিশেষে আমি বলতে চাই, যাদের অন্য কোন অপশন আছে তারা দয়া করে এই চাকরিতে আসবেন না। আয় কম হলেও গ্রামে ফ্যামিলির সাথে থাকার চেষ্টা করুন। একদম সত্য বলছি, আপনি ভালো থাকবেন, অনেক ভালো। জেনেশুনে দোযখে পা দিতে আসবেন না।

আর যাদের নিজের ইচ্ছে আছে, উপরের সব বর্ণনাগুলো মন থেকে মেনে নিতে পারবেন, কঠোর পরিশ্রম করতে পারবেন, মিথ্যা বলতে পারবেন, তেল মারতে পারবেন, একটা ইনকাম ইমার্জেন্সী দরকার তারা চলে আসুন। তাদের ওয়েলকাম। আমি সব কাজকেই শ্রদ্ধা করি। হোক সেটা বড় কিংবা ছোট। কিন্তু যে কাজে তেল মারতে হয়, মিথ্যা বলতে হয় সেটা কোন ভালো কাজ হতে পারে না।

আপনারা জানলে অবাক হবেন যে, আমি নিজেও এই চাকরি করছি। তবে খুব বেশিদিন এখানে থাকবো না। বের হয়ে যাবো। সবসময়ই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। আপনারাও আমার জন্য দোয়া করবেন। তবে মার্কেটিং চাকরির কিছু পজিটিভ দিকও আছে। সেসব নিয়ে সময় পেলে আরেকদিন আলোচনা করবো। সবাই ভালো থাকবেন আর নিজের যত্ন নিবেন। আর নিজের কিছু থাকলে সেটা থেকেই শুরু করুন বিজনেস। হয়ে উঠুন একজন উদ্যোক্তা। আশা করি, আপনার জীবনে ভালো কিছু হবে।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর পরেও কিছু মানুষের আফসোস করতে হবে যে কারনে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *