বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলো কৃষি। কিন্তু এই কৃষিই আজ নানা সংকটে জর্জরিত। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০% কৃষক ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, কৃষিজমির টেকসই ব্যবস্থাপনা, সেচের অভাব এবং রাসায়নিক সারের অপরিকল্পিত ব্যবহার কৃষিখাতকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আজকের ব্লগে আমরা এই সংকটগুলো বিশ্লেষণ করব এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজব।
ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত ৪০% কৃষক
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি জরিপ ২০২৫’ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৪০% কৃষক জাতীয় কৃষিমজুরি (দৈনিক ৬০০ টাকা) থেকে কম আয় করেন। অর্থাৎ, প্রতি চার জন কৃষকের মধ্যে দুই জনই ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না।
আঞ্চলিক বৈষম্য
সিলেট ও খুলনা সবচেয়ে পিছিয়ে: সিলেটে ৬৩% এবং খুলনায় ৬০% কৃষক ন্যায্য মজুরি পান না।
ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে কিছুটা উন্নতি: এখানে যথাক্রমে ৭৫% ও ৭৩% কৃষক ন্যায্য মজুরি পান।
শহর vs গ্রাম: শহরে ৭৬% কৃষক ন্যায্য মজুরি পেলেও গ্রামে এই হার মাত্র ৫৯%।
এই বৈষম্য কৃষকদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে এবং কৃষিখাতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
টেকসই নয় অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি
জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৫৭% কৃষিজমি টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। এসব জমিতে কৃষিঋণ, বীমা ও আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছায়নি। ফলে, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির ঝুঁকি বাড়ছে।
জমির অলাভজনক ব্যবহার
২১% কৃষিজমি গত তিন বছরে কোনো লাভজনক ফসল উৎপাদন করতে পারেনি।
শহরাঞ্চলে এই হার আরও বেশি—২৫%।
এই পরিস্থিতি কৃষকের আর্থিক সংকটকে আরও তীব্র করছে।
সেচের অভাব ও রাসায়নিকের অপরিকল্পিত ব্যবহার
সেচের সংকট
দেশের ১৮% কৃষিজমিতে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা নেই। ফলে, এসব জমিতে প্রত্যাশিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়।
সার ও কীটনাশকের অপব্যবহার
৪৩% জমিতে সারের সঠিক ব্যবহার হয় না। ইউরিয়া ও অন্যান্য রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে।
৪৯% জমিতে পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না, যা মানস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার সঠিকভাবে বলেছেন, “শুধু উৎপাদন বাড়ালে হবে না, পরিবেশও রক্ষা করতে হবে।”
সমাধানের পথ
১. ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে।
২. টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা
কৃষিজমিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে।
কৃষিঋণ ও বীমা সুবিধা সহজলভ্য করতে হবে।
৩. সঠিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার
কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রাসায়নিক সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
জৈব সার ও পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, কৃষকরা আমাদের খাদ্যের যোগানদার, অথচ তারাই ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা, সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা বাড়ালেই কেবল এই সংকট কাটানো সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই সচেতন হই এবং কৃষকদের পাশে দাঁড়াই।
আরও পড়ুন: শাপলা চাষ: বাড়িতেই গড়ে তুলুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জলকেন্দ্র
আপনার মতামত জানান—কীভাবে আমরা কৃষকদের আরও ভালোভাবে সহায়তা করতে পারি?