বর্তমান যুগে প্রযুক্তির সুবিধার পাশাপাশি এর অপব্যবহারও বেড়ে চলেছে। রাজধানীর ডেমরা এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে পরকীয়া, ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেইল ও যৌন হয়রানির মতো অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পর্নোগ্রাফি আসক্তি ও ডিজিটাল অপরাধের প্রভাবকে দায়ী করছেন। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ডেমরায় অপরাধের চিত্র: পরিসংখ্যান ও ঘটনাপ্রবাহ
গত কয়েক বছরে ডেমরায় একাধিক ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেইল ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ ও মিডিয়া সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো:
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক যুবককে গৃহবধূর নগ্ন ভিডিও ফাঁস করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
২০২৪ সালের জুনে এক তরুণীকে প্রেমের নামে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করার অভিযোগে এক যুবক আটক হয়।
২০২৫ সালের মার্চে প্রবাসীর স্ত্রীর ছোট বোনের নগ্ন ভিডিও করে বড় বোনকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনায় এক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়।
এপ্রিলে এক কলেজছাত্রীর ব্যক্তিগত ছবি পর্ন সাইটে আপলোড করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে দুই যুবক আটক হয়।
এসব ঘটনা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যই চ্যালেঞ্জ নয়, বরং সমাজের নৈতিক অবক্ষয়েরও ইঙ্গিত বহন করে।
পর্নোগ্রাফি আসক্তি: অপরাধের মূল কারণ?
মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিদদের মতে, পর্নোগ্রাফির অত্যধিক ব্যবহার মানসিক বিকৃতি ও বিকৃত যৌনাচারের দিকে ধাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে, তাদের মধ্যে:
বাস্তব জীবনে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা কমে যায়।
নারীদের প্রতি সম্মানহীনতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, বিশেষ করে যৌন নিপীড়ন ও ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক, যারা সহজেই এসব ক্ষতিকর কনটেন্টের সংস্পর্শে আসছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও এর সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশ সরকার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে:
২০১৯ সালে প্রায় ২০,০০০ পর্ন সাইট বন্ধ করা হয়।
২০২৫ সালে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ সাইট ব্লক করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এসব পদক্ষেপ পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। ব্যবহারকারীরা VPN (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ও প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে নিষিদ্ধ সাইটে প্রবেশ করছে। এছাড়া এনক্রিপ্টেড ট্রাফিক মনিটরিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
অভিভাবক ও সমাজের ভূমিকা
শুধু আইন দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। পরিবার ও সমাজকেও সচেতন হতে হবে:
✅ প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করে শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহার মনিটর করা।
✅ খোলামেলা আলোচনা: বাবা-মায়েদের উচিত সন্তানদের সাথে ইন্টারনেট সেফটি ও নৈতিকতা নিয়ে কথা বলা।
✅ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা: সঠিক মূল্যবোধ গঠনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতা
ডেমরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাহমুদুর রহমান জানান, “আমরা অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনছি। তবে শুধু পুলিশের প্রচেষ্টায় এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়, সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
উপসংহার
ডেমরায় ক্রমবর্ধমান অপরাধের পেছনে প্রযুক্তির অপব্যবহার ও পর্নোগ্রাফি আসক্তি একটি বড় কারণ। এই সমস্যা সমাধানে সরকার, অভিভাবক, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং নৈতিক শিক্ষা দিয়ে আমরা একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
আরও পড়ুন: ডুমুরিয়ায় নৃশংস শিশু ধর্ষণ: অপরাধীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো স্থানীয়রা
আপনার সন্তান কি নিরাপদ? আজই সচেতন হোন, পরিবার ও সমাজকে রক্ষায় এগিয়ে আসুন।