বাংলা গানের ইতিহাসে এমন কিছু কণ্ঠ আছে, যাদের কণ্ঠ শুনলে হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিও জেগে ওঠে। তেমনি একজন কিংবদন্তি শিল্পী হলেন এন্ড্রু কিশোর। যিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে আছেন তার কণ্ঠের যাদু দিয়ে। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবে তার গান ও সুরের আবেগ আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত।
পরিচয় ও শিক্ষাজীবন
এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ৪ নভেম্বর ১৯৫৫ সালে, রাজশাহী শহরে। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি ছিল অগাধ টান। তার বাবা ছিলেন রাজশাহী সরকারি কলেজের কর্মচারী, আর মা ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলাতেই গানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন রাজশাহীর বিখ্যাত সংগীত প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমিতে।
পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (MBA) ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু গানই ছিল তার জীবনের মূল ধারা।
গানের জগতে যাত্রা
এন্ড্রু কিশোরের পেশাদার সংগীত জীবনের শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। তবে তার বড় সুযোগ আসে ১৯৭৯ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত “প্রতিনিধি” চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার মাধ্যমে। সেখানে তিনি গেয়েছিলেন নন্দিত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এবং অলীউল্লাহ খানের সুরে “একচোখে অন্ধ যারা” গানটি, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার “প্লেব্যাক কিং”।
ব্যক্তিগত জীবন
এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু নিজেও সংগীতচর্চা করতেন। তাদের দুটি সন্তান—জয় এন্ড্রু ও মারিয়া এন্ড্রু। তারা বর্তমানে বিদেশে বসবাস করছেন। এন্ড্রু কিশোর সবসময় পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং সংগীতের বাইরে পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন।
তার অমর কিছু গান
এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া হাজারো জনপ্রিয় গানের মধ্যে কয়েকটি শ্রোতাদের মনে গেঁথে আছে চিরদিনের মতো:
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস – (ভালোবাসা ভালোবাসা)
ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে – (প্রেমিক)
জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প – (জীবন থেকে নেয়া)
আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি – (ভেজা চোখ)
আমার বুকের মধ্যে খানে – (ভালোবাসা ভালোবাসা)
তুমি আমার জীবন – (শুভদৃষ্টি)
আমার হৃদয় যে তোমারই জন্য – (রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত)
চেনা চেনা লাগে আজ – (চেনা মুখ)
আমি চিরদিন তোমার পথ চেয়ে – (শুভ বিবাহ)
ভালোবেসে তোমায় আমি – (অভিনয়)
শেষ অধ্যায়: মৃত্যুর দিন
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ৬ জুলাই ২০২০ সালে থেমে যায় সুরের এই মহান সাধকের প্রাণ। তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে ও পরে বাংলাদেশে। মৃত্যুকালে তিনি রাজশাহীর নিজ বাড়িতেই ছিলেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়।
এন্ড্রু কিশোরের অবদান
বাংলা চলচ্চিত্রে ৮ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন।
আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
একাধিক যুগের সংগীত পরিচালক ও শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, দেশাত্মবোধক, আধুনিক ও ভক্তিমূলক গানেও রেখেছেন চিরস্থায়ী ছাপ।
আমাদের হৃদয়ে এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর চলে গেলেও, তার কণ্ঠ আজও রয়ে গেছে অগণিত শ্রোতার মনের মণিকোঠায়। বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার গান যেমন ভালোবাসার কথা বলে, তেমনই বলে হারানোর বেদনা, জীবনের গল্প, সমাজের কথা।
তার প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সুরের এই মহান সাধক চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।
আরও পড়ুন: সাইফ আলি খানের ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হারানোর আশঙ্কা! আইনি যুদ্ধে কী হবে বলিউড স্টারের?
আপনার প্রিয় এন্ড্রু কিশোরের গান কোনটি? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না।