নরসিংদীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেন এক মহান ব্যক্তি, যিনি ৩৭ বছর ধরে বিনা বেতনে পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে যাচ্ছেন। কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতির আশা না করে, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিনি এই মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তার নাম হাজি মো. হাফিজ উদ্দীন। আজানের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা এবং নিষ্ঠা এলাকাবাসীর হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছে।
শুরুটা যেভাবে
১৯৮৮ সালের কথা। নরসিংদী সদরের মহিষাশুরার চান্দেরপাড়া গ্রামে তখন মসজিদটি ছিল ছোট, পাঞ্জেগানা। নিয়মিত মুয়াজ্জিন না থাকায় যে আগে আসতেন, তিনিই আজান দিতেন। হাফিজ উদ্দীনও মাঝেমধ্যে আজান দিতেন। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হলে তিনি নিয়মিত আজান দেওয়া শুরু করেন।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন সবার আগে মসজিদে পৌঁছে যান। মসজিদ পরিষ্কার করা, পানি তোলা, মোটর চালানো—সব কাজই করেন স্বেচ্ছায়। তার আজানের সুর গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙায়, নামাজের ডাকে জাগ্রত করে।
আজানের জন্য ত্যাগ
হাফিজ উদ্দীনের জীবনে আজানই সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তিনি কখনোই ফজরের আজান মিস করতে চান না। তাই কারো বাড়িতে রাত যাপন করেন না। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়িতে গেলেও ফজরের আগেই ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, “আজান দিতে না পারলে আমার মন কেমন করে। মসজিদের মাইকের দিকে টান লাগে। আজানের এই টান আমাকে সবসময় মসজিদে নিয়ে যায়।”
আল্লাহর ভালোবাসায় আজান
টাকা-পয়সা বা সম্মানের লোভে নয়, হাফিজ উদ্দীন আজান দেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তিনি বলেন, “একবার একজন আলেমের বয়ান শুনেছিলাম, মুয়াজ্জিনের মর্যাদা অনেক বেশি। সেই থেকে আজান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমার একমাত্র লক্ষ্য।”
পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
হাফিজ উদ্দীনের সন্তানরা তার এই নিষ্ঠাকে গর্বের চোখে দেখেন। তার ছেলে সোলাইমান বলেন, “আমার বাবা আজীবন বিনা বেতনে আজান দিয়েছেন। মানুষ তাকে সম্মান করে, এটা আমাদের জন্য গৌরবের।”
গ্রামবাসীরাও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তার আজানের সুর শুনে অনেকেই নামাজের জন্য মসজিদে আসেন।
মুয়াজ্জিনের ফজিলত
ইসলামে মুয়াজ্জিনের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। হাদিসে এসেছে:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনদের গর্দান সবচেয়ে উঁচু হবে।” (মিশকাতুল মাসাবিহ)
আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ১২ বছর আজান দেবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)
আবু সাইদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, “মুয়াজ্জিনের আজানের আওয়াজ যতদূর যায়, সে পর্যন্ত সবকিছু কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।” (সহিহ বুখারি)
উপসংহার
হাজি হাফিজ উদ্দীনের জীবন আমাদের শেখায়—নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই প্রকৃত সফলতা। টাকা-পয়সা বা পার্থিব সম্মানের আশা না করে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করাই হলো প্রকৃত ইবাদত।
তার মতো মানুষরা সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা। আল্লাহ তাকে দীর্ঘায়ু দিন, যেন তিনি আরো বহু বছর আজানের মাধ্যমে মানুষকে নামাজের দিকে ডাকতে পারেন। আমিন।
আরও পড়ুন: পবিত্র আশুরা ২০২৫: বাংলাদেশে কবে পালিত হবে?