ঢাকার ধামরাই উপজেলায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণের পর ঘটনাটি সালিশের মাধ্যমে ‘মীমাংসা’ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই সালিশে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের হাতে কোনো ন্যায়বিচার পৌঁছায়নি। বরং মাতব্বররা জরিমানার টাকা পকেটস্থ করে নিয়েছে, যা আইনের চোখে একটি গুরুতর অপরাধ। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে—আদৌ কি সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের নিষ্পত্তি সম্ভব? নাকি এটি শুধুই স্থানীয় প্রভাবশালীদের অর্থলোলুপতার একটি হাতিয়ার?
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
শুক্রবার দিবাগত রাতে ধামরাই উপজেলার কুসুরা ইউনিয়নের নবগ্রাম বাজারে এক গৃহবধূকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ করে স্থানীয় এক যুবক জাহাঙ্গীর আলম। ঘটনার পর স্থানীয়রা ধর্ষককে আটক করলে, তার ভাগ্নে (এক বিজিবি সদস্য) মধ্যস্থতা করে এবং শনিবার সালিশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরদিন, নবগ্রাম বাজারের এক বাড়িতে সালিশ বসে। সেখানে ধর্ষককে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নগদ এবং ২ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি ব্যাংক চেক জরিমানা করা হয়। কিন্তু এই টাকার একটি পয়সাও ধর্ষিতার পরিবার পায়নি। বরং সালিশকারী মাতব্বর সোলায়মান হোসেন গংগা ও তার সহযোগীরা টাকাগুলো হাতিয়ে নেয়।
সালিশি বিচার: ন্যায়বিচার নাকি প্রভাবশালীদের খেলা?
সালিশের মাধ্যমে পারিবারিক বা সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি আমাদের সমাজের একটি প্রচলিত প্রথা। কিন্তু ধর্ষণের মতো অ-compoundable offense (যে অপরাধ আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায় না) সালিশের মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং দণ্ডনীয়।
কেন এই সালিশ অবৈধ?
ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ, যা শুধুমাত্র আদালতের এখতিয়ারে বিচারযোগ্য।
জরিমানার টাকা ভুক্তভোগীর পরিবার না পেয়ে মাতব্বরদের পকেটে যাওয়া দুর্নীতির শামিল।
স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা—পুলিশ জানিয়েছে, তারা এই সালিশের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন, যা প্রশাসনের দুর্বলতাকে ফুটিয়ে তোলে।
ধর্ষিতার বক্তব্য: বিয়ের প্রলোভন ও শোষণের শিকার
ধর্ষিতা নারী জানান, “জাহাঙ্গীর আমাকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। সালিশে টাকা আদায় করা হলেও, আমার পরিবার কিছুই পায়নি।” এই মামলায় ন্যায়বিচার পেতে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা
কাউলিপাড়া থানার ইনচার্জ পরিদর্শক নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “ধর্ষণের অভিযোগ পেয়েছি, কিন্তু সালিশের বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। তদন্ত চলছে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে প্রশ্ন হলো—
কেন স্থানীয় পুলিশ সালিশের বিষয়ে অজানা থাকল?
ধর্ষককে আটক করার পর বিজিবি সদস্যের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দেওয়া হলো কীভাবে?
মাতব্বররা কীভাবে এত বড় অপরাধকে টাকার বিনিময়ে চাপা দিতে সাহস পেল?
সমাজের দায়িত্ব: ন্যায়বিচার চাই
এই ঘটনা শুধু একটি ধর্ষণের কাহিনী নয়, এটি আমাদের সমাজের অপশক্তি ও দুর্নীতির চিত্রও ফুটিয়ে তোলে।
কী করা উচিত?
✅ ধর্ষকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া প্রয়োজন।
✅ সালিশকারী মাতব্বরদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যারা আইন হাতে নিয়েছে।
✅ পুলিশ ও প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী আইন নিজের হাতে নিতে না পারে।
✅ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে—ধর্ষণের মতো অপরাধ কখনোই সালিশে মেটানো যায় না।
উপসংহার
ধামরাইয়ের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আজও আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রভাবশালীদের হাতে ঢাকা পড়ে যায়। সালিশের নামে টাকা লুটপাট, ধর্ষকের রেহাই এবং ভুক্তভোগীর বঞ্চনা—এসবই প্রমাণ করে যে, শক্তিশালী আইন ও এর সঠিক প্রয়োগ ছাড়া নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: শেওড়াপাড়ায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড: দুই বোনকে শিল-পাটা ও ছুরিকাঘাতে হত্যা
আইন নিজের হাতে নেওয়ার এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ধর্ষকের বিচার আদালতেই হোক, সালিশে নয়।
#নারী_নিরাপত্তা #ধর্ষণের_বিচার #সালিশ_নয়_আদালত_চাই
ব্লগার হিসেবে আমার দায়িত্ব—এই ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সোচ্চার হওয়া এবং সমাজকে সচেতন করা। আপনি কী মনে করেন? নিচে কমেন্টে জানান। ধন্যবাদ।