গাজীপুরের বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সেবা পাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য এক অসম যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। জমির নামজারি, খারিজ, মিস মোকাদ্দমা বা খাসজমি বন্দোবস্ত—প্রতিটি কাজেই ঘুষ ও দুর্নীতির দাপট। সরকারি ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না, মাসের পর মাস হয়রানির শিকার হতে হয় সেবা প্রার্থীদের। সরেজমিনে গাজীপুরের বিভিন্ন ভূমি অফিস ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
ঘুষের দাপট: টাকা ছাড়া ফাইল এগোয় না
গাজীপুরের শ্রীপুর, সদর, কালীগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার ভূমি অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ সঠিক কাগজপত্র নিয়ে গেলেও চাহিদামতো টাকা না দিলে তাদের আবেদন গ্রহণই করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়েও মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়।
নামজারি ও খারিজে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়।
সরকারি ফি সম্পর্কে অসচেতনতা কাজে লাগিয়ে দালাল ও টাউটরা সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে।
টাকা দিলে ছেঁড়া দলিলেও কাজ হয়, না দিলে কাগজপত্র আলমারিতে আটকে রাখা হয়।
ভুক্তভোগীদের করুন কাহিনী
১. শিক্ষক হান্নান সরকারের দুর্ভোগ
গাজীপুরের বাসন ইউনিয়নের এক বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান সরকার জমির খারিজের জন্য আবেদন করেছিলেন। ভূমি অফিস থেকে কাগজপত্র এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানোর কথা থাকলেও, টাকা না দেওয়ায় তা পাঠানো হয়নি। অথচ ভূমি অফিস দাবি করে, কাগজ পাঠানো হয়েছে। ফলে তিনি দুই অফিসেই ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
২. কৃষক শহীদুল ইসলামের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা
শ্রীপুর উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের কৃষক শহীদুল ইসলাম এক বিঘা জমির নামজারির জন্য উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তার কাছে ৮ হাজার টাকা দেন। অর্ধেক টাকা দেওয়ার পর আবেদন নেওয়া হলেও দুই বছর পার হওয়ার পরও কাজ শেষ হয়নি। বারবার যোগাযোগ করলে “সার্ভার ডাউন” বা “অফিসে কর্মকর্তা নেই” এমন অজুহাত দেখানো হয়।
৩. বৃদ্ধ রুহুল আমিনের হতাশা
কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের রুহুল আমিন ছয় মাস আগে জমি খারিজের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং ৬ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও তার কাজ শেষ হয়নি। তিনি জানান, “সরকারি ফি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, তাই বেশি টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছি।”
দালাল ও টাউটদের দৌরাত্ম্য
অধিকাংশ ভূমি অফিসের সামনে দালাল ও টাউটদের উপস্থিতি প্রকট। তারা সাধারণ মানুষকে বোঝায় যে, সরকারি ফিতে কাজ হবে না। এরপর অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজের নামে শুধু সময়ক্ষেপণ করে।
মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে দালালরা পালিয়ে যায়।
নিয়াজ আলী নামের এক ব্যক্তি ১০ হাজার টাকা দিয়েও চার মাস ধরে একই কাজের জন্য ঘুরছেন।
প্রশাসনের বক্তব্য: ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কায়সার খসরু জানান, ভূমি সেবাকে সহজলভ্য করতে ডিজিটালাইজেশন ও ভূমি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, “ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গত ৬ মাসে কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
সরকারি ফি জানুন, দালালদের এড়িয়ে চলুন
সরকার প্রতিটি ভূমি সংক্রান্ত কাজের জন্য নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করেছে। দালালদের ফাঁদে পড়ার আগে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলুন:
✅ সিটিজেন চার্টার দেখে সরকারি ফি সম্পর্কে জানুন।
✅ অনলাইন সেবা (যদি থাকে) ব্যবহার করে সরাসরি আবেদন করুন।
✅ রসিদ ছাড়া টাকা দেবেন না, যেকোনো অনিয়মের অভিযোগ জেলা প্রশাসনে জানান।
উপসংহার
গাজীপুরের ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতি ও হয়রানি এখনও ব্যাপক। তবে ডিজিটালাইজেশন ও সচেতনতা বাড়লে এই সমস্যা কমবে বলে আশা করা যায়। সাধারণ মানুষকে সরকারি ফি সম্পর্কে জানতে হবে এবং দালালদের এড়িয়ে আইনানুগভাবে কাজ করতে হবে। প্রশাসনকেও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে ভূমি অফিসগুলো সত্যিকারের জনসেবার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন: নৃশংস হত্যাকাণ্ড: স্ত্রীকে ১১ টুকরো করে হত্যা, স্বামী পলাতক
#গাজীপুর #ভূমি_অফিস #দুর্নীতি #সরকারি_সেবা #ঘুষ_বিরোধী