ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) রোগ যা সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এটি শুধুমাত্র রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সমস্যা নয়—এর প্রভাব শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মারাত্মকভাবে বিস্তার ঘটাতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের প্রতি সচেতনতা, সময়মতো পরীক্ষা ও সঠিক জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াবেটিস রোগ কতটা ভয়াবহ?
ডায়াবেটিসের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটি অনেক সময় লক্ষণ ছাড়াই শরীরের ভেতরে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে চোখের সমস্যা (দৃষ্টিহানি), কিডনি বিকল, হৃদরোগ, স্নায়ু ক্ষতি, পায়ের ক্ষত ও কেটে পচে যাওয়া পর্যন্ত হতে পারে। তাই এটিকে বলা হয় নীরব ঘাতক।
ডায়াবেটিস হলে জীবনে কেমন পরিবর্তন আনা প্রয়োজন?
ডায়াবেটিস ধরা পড়লে জীবনযাপনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা আবশ্যক:
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন: কম ক্যালোরি, কম চিনি ও কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইক্লিং বা হালকা এক্সারসাইজ জরুরি।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা।
মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস হরমোনও রক্তে গ্লুকোজ বাড়াতে পারে।
কোন ধরণের খাবার একেবারেই খাওয়া উচিত নয়?
সাদা ভাত ও চিনি জাতীয় খাবার
সুগারযুক্ত কোমল পানীয় ও জুস
বেকারি আইটেম (কেক, বিস্কুট, ডোনাট)
প্রসেসড ফুড ও জাঙ্ক ফুড
ফাস্টফুড (বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই)
কোন খাবারগুলো খাওয়া প্রয়োজন?
ফাইবারযুক্ত শাকসবজি (লাল শাক, পালং শাক, করলা)
লো গ্লাইসেমিক ফল (আপেল, পেয়ারা, জাম)
বাদাম (আমন্ড, আখরোট)
বাল্বজাতীয় খাদ্য (ওটস, ব্রাউন রাইস, আটার রুটি)
চিকেন ও মাছ (গ্রিল বা সেদ্ধ করা)
কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি?
বারবার প্রস্রাব, অতিরিক্ত তৃষ্ণা বা ক্ষুধা
হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া
চোখে ঝাপসা দেখা
পায়ের তালুতে অসাড়তা বা চুলকানি
ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডায়াবেটিসের জটিল পরিস্থিতিগুলো কী কী?
ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজ (Nephropathy)
চোখের রেটিনা ক্ষতি (Retinopathy)
পায়ের সমস্যা ও গ্যাংগ্রিন
হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক
ডায়াবেটিক কোমা (অত্যধিক গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া)
ভালো থাকার জন্য ডায়াবেটিসের শুরু থেকেই কেমন জীবনবিধান প্রয়োজন?
নিয়মিত রক্তে সুগার পরীক্ষা করা
ওষুধ বা ইনসুলিন যথাসময়ে গ্রহণ
প্রতিদিন একই সময় খাওয়া-দাওয়া করা
ঘুম ঠিক রাখা ও রাতজাগা এড়িয়ে চলা
ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা
পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা: কোন দিকে যাচ্ছে ডায়াবেটিস?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ৫৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এর হার দ্রুত বাড়ছে। আধুনিক জীবনযাত্রা, স্থূলতা, পরিশ্রমের অভাব ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এই প্রবণতার জন্য দায়ী।
আমরা কীভাবে সচেতন হব?
পরিবারে ডায়াবেটিস রোগী থাকলে ৩০ বছর বয়স থেকেই প্রতি বছর ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা উচিত
শিশুদের Junk Food অভ্যাস দূর করা
স্বাস্থ্য শিক্ষায় ডায়াবেটিস বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা
কর্মস্থলে সুস্থ জীবনচর্চা উৎসাহিত করা
উপসংহার
ডায়াবেটিস কোনো অভিশাপ নয়, যদি আমরা তা সঠিকভাবে মোকাবিলা করি। সচেতনতা, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে এই নীরব ঘাতক থেকে নিজেকে এবং প্রিয়জনকে রক্ষা করা সম্ভব। আসুন, আজ থেকেই আমরা এক নতুন স্বাস্থ্যকর জীবনের পথে হাঁটি।
আরও পড়ুন: প্রাকৃতিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায়