একটি সুস্থ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য শুধু ভালো কাজ করাই যথেষ্ট নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে অন্যায়ের প্রতিবাদকে ইবাদতের সমতুল্য গণ্য করা হয়েছে। অথচ আজ অনেকেই নিজের নিরাপত্তা বা স্বার্থের ভয়ে অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকেন। কিন্তু এই নীরবতা শুধু সমাজকে নষ্ট করে না, ব্যক্তির ঈমানকেও দুর্বল করে দেয়।
অন্যায়ের প্রতিবাদ: ইসলামের নির্দেশ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে।” (সুরা আলে ইমরান: ১১০)
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি ঈমানের দাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে বাধা দেয়। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে। যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করবে। কিন্তু এটা ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।” (সহিহ মুসলিম: ৭৪)
অর্থাৎ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরবতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিবাদ না করার অর্থ হলো অন্যায়কারীকে সমর্থন করা।
নীরবতার পরিণতি: শাস্তি অবধারিত
অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে শুধু সমাজই নয়, ব্যক্তিও আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি হবে। আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যখন মানুষ কোনো অন্যায় দেখেও তা প্রতিরোধ না করে, আল্লাহ তাদের সবার ওপর শাস্তি নাজিল করেন।” (তিরমিজি: ২১৬৮)
আরও ভয়াবহ হলো, এমন সমাজে দোয়া কবুল হয় না। হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দেবে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না কর, আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি প্রেরণ করবেন। তখন তোমরা দোয়া করলেও তা কবুল হবে না।” (তিরমিজি: ৪০৬)
অন্যায়ের নীরব সমর্থকরা ধ্বংসের কারণ
অনেকেই ভাবে, “আমার ওপর অন্যায় না হলে আমি কেন প্রতিবাদ করব?” কিন্তু এই চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল। নু’মান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি উদাহরণ দিয়েছেন:
“একদল লোক একটি নৌকায় ভ্রমণ করছিল। নিচতলার যাত্রীরা পানি নেওয়ার জন্য ওপরতলায় যেত। একসময় তারা ভাবল, ‘আমরা যদি নৌকার তলায় ছিদ্র করে নিজেদের জন্য পানি সংগ্রহ করি, তাহলে ওপরতলার লোকদের বিরক্ত করতে হবে না।’ যদি ওপরের লোকেরা তাদের এই কাজ করতে দেয়, তাহলে সবাই ডুবে মরবে। কিন্তু যদি তারা বাধা দেয়, তবে সবাই বেঁচে যাবে।” (সহিহ বুখারি: ২৪৯৩)
এই হাদিস থেকে শিক্ষা হলো—অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে তা একদিন সবার ধ্বংস ডেকে আনে।
প্রতিবাদ কীভাবে করবেন?
অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিভিন্ন উপায় রয়েছে:
শক্তি দিয়ে (যদি সম্ভব হয়): যেমন, জালিম শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
বাক্য দিয়ে: সমাজে বা মিডিয়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা।
মনে ঘৃণা পোষণ করা: অন্তত এই স্তরটুকু বজায় রাখা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” (আবু দাউদ: ৪৩৪৪)
উপসংহার
অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরবতা শুধু পাপ নয়, এটি সমাজের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে। ইসলাম আমাদেরকে অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়। যারা চুপ থাকে, তারা শুধু নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং পুরো সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তাই আসুন, আমরা সচেতন হই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হোন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।
“সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া ন্যায়পরায়ণতার পরিচয়।”
আরও পড়ুন: গাছ লাগান: জীবন্ত সদকার সওয়াব ও প্রাকৃতিক সম্পদ